এটা অত্যন্ত দুঃখের কথা যে পুরাতাত্ত্বিক ঐশ্বর্যের বিচারে পশ্চিমবঙ্গে কোচবিহার জেলার যে গুরুত্ব পাওয়া উচিত ছিল কোচবিহার তা পায়নি। অথচ বাংলার ইতিহাসের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের স্মৃতিচিহ্ন কোচবিহার জেলার পথে প্রান্তরে অত্যন্ত অবহেলার মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে আর নিঃশব্দে ঘোষণা করে চলেছে যে আত্মবিস্মৃত বাঙালিজাতির কোনও ইতিহাসবোধ নেই।
সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের শুধু এই উক্তিই নয়, তার দেবী চৌধুরানী উপন্যাসও বহু লোকে পড়েছেন। কিন্তু অনেকেই মনে রাখেননি স্বামী পরিত্যক্তা অসহায়া গ্রাম্য তরুণী প্রফুল্লর দেবী চৌধুরানীতে রূপান্তরের নেপথ্য ইতিহাস। প্রফুল্ল যদি পোড়ো বাড়িতে মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধ বৈষ্ণবের আবিষ্কৃত রাজা নীলাম্বরের গুপ্তধনের উত্তরাধিকারী না হত তাহলে তার সোনার মোহর ভাঙানোর দরকার হত না। আর তাহলে তার ভবানী পাঠকের সাহায্য লাভের দরকারও হত কিনা সন্দেহ। আর ভবানী পাঠককে এভাবে দরকার না হলে প্রফুল্লর দেবী চৌধুরানীতে রূপান্তরও এভাবে হত না।
এ তো গেল প্রফুল্লর কথা। কিন্তু এই যে রাজা নীলাম্বরের কথা বঙ্কিমচন্দ্র লিখে গেছেন, তিনি কে, সে সম্বন্ধে বাঙালি পাঠকেরা বিশেষ কেউই উৎসাহ বোধ করেন না। কারণ তাকেও তারা অনেকেই উপন্যাসের কাল্পনিক চরিত্র বলেই মনে করেন। অথচ রাজা নীলাম্বর রীতিমতো এক ঐতিহাসিক চরিত্র, আর সাহিত্য সম্রাট তা শুধু জানতেনই না, তার রাজধানী কামতাপুরেরও খোঁজ খবর রাখতেন তিনি। সেই কামতাপুর নগর সম্বন্ধে তিনি কী বলেছেন তা তার ভাষাতেই দেখা যাক এখানে।
“ইহার পরিধি ৯১/২ ক্রোশ, অতএব নগরী অতি বৃহৎ ছিল সন্দেহ নাই। ইহার মধ্যে সাত ক্রোশ বেড়িয়া নগরীর প্রাচীর ছিল। আর ২১/২ ক্রোশ একটি নদীর দ্বারা রক্ষিত। প্রাচীরের ভিতর প্রাচীর; গড়ের ভিতর গড়— মধ্যে রাজপুরী।”
এই সুপ্রাচীন সুবৃহৎ কামতাপুর শহর কোথায়, উত্তরবঙ্গে বাস করেও অনেকেই তা জানেন না। কোচবিহার শহর থেকে দিনহাটা মহকুমা শহরের প্রায় দশ কিলোমিটার পশ্চিমে এখনকার গোঁসানিমারি গ্রামটি এই প্রাচীন কামতাপুর শহরের প্রধান স্থান।