কবিশেখর কালিদাস রায় বাঙালি পাঠকের কাছে একটি অত্যন্ত পরিচিত নাম। বাংলা সাহিত্য গগনে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র বলা যায়। তিনি ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, ছান্দসিক, বৈয়াকরণ, সাহিত্য সমালােচক, শিক্ষাব্রতী ও ভাষাতত্ত্ববিদ। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন আদর্শ শিক্ষক। শিক্ষা জগতে তার নবচিন্তন শিক্ষাব্রতেরই অনুসরণ করছেন পরবর্তী শিক্ষক সমাজ। উত্তর জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত বহু কৃতী ছাত্রের তিনি ছিলেন শিক্ষাগুরু। এই ছাত্র দরদী কবির অমর কবিতা ছাত্রধারা বাংলা দেশের এমন কোন শিক্ষার্থী নেই, যাঁরা পড়েন নি।
কবিশেখরের সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতি স্বরূপ বিশ্বভারতী তাঁদের সর্বোচ্চ ‘দেশিকোত্তম’ উপাধি দানে সম্মানিত করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সাহিত্য ও কাব্যে শ্রেষ্ঠ কীর্তির জন্য জগত্তারিণী স্বর্ণপদক ও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে গবেষণার জন্য সরােজিনী স্বর্ণপদক দিয়ে সম্মানিত করেন। রবীন্দ্রভারতী ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি. লিট উপাধি দেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার পূর্ণাহুতি কাব্যগ্রন্থের জন্য তাকে রবীন্দ্র পুরস্কার প্রদান করেন।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে তাঁর সাহিত্য যাত্রা শুরু হয়। তারপর ৭০ বছর ধরে অক্লান্ত সাহিত্য সাধনা করে গেছেন। এই ৭০ বছরের সাহিত্য জীবনে তিনি অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেন। তার মধ্যে কাব্য, অনুবাদ কাব্য, সমালােচনা সাহিত্য, রম্য রচনা, কিশোর বা শিশুসাহিত্য, ব্যাকরণ, ভাষাতত্ত্ব, ছন্দ, অলংকার, বাংলা অভিধান উল্লেখযোগ্য। এই ৭০ বছরের সাহিত্য জীবনে তিনি কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, ঐতিহাসিক, বিজ্ঞানী, সঙ্গীতশিল্পী প্রমুখ অসংখ্য মনীষীর সংস্পর্শে আসেন। কবিশেখরের সঙ্গে চিঠিপত্রের মাধ্যমে তাঁদের নিয়মিত ভাবের আদানপ্রদান হতো।
পত্রকারদের মধ্যে বিশিষ্ট কয়েকজন হলেন : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সম্পাদক ও প্রাবন্ধিক প্রমথ চৌধুরী, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, সাংবাদিক ও সাহিত্যসেবী হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ভাষাবিদ ও অধ্যাপক বিধুশেখর শাস্ত্রী, পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন, রাজশেখর বসু, অমল হোম, অধ্যাপক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, দিলীপকুমার রায়, অধ্যাপক সুশীলকুমার দে, ঐতিহাসিক ও চিন্তাবিদ রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় ও রাধাকমল মুখোপাধ্যায়, সাহিত্য সমালোচক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বনফুল, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার, পরিমল গােস্বামী, কবি করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক, কবি যতীন বাগচী, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, জসীমউদ্দীন প্রমুখ আরাে অনেক গুণীজন।
এই পত্রগুলিতে সেকালের সমাজ চিত্র, সংস্কৃতি, আচার বিচারের অনেক পরিচয় পাওয়া যাবে। ৭০ বছরের অনেক ইতিহাস, অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সেকালের কবি-লেখকেরা কিরকম অনাড়ম্বর জীবনযাপন করতেন তারও একটা পরিচয় এইসব পত্রে পাওয়া যায়। একে অপরের সঙ্গে শ্রদ্ধা-বন্ধুত্ব-স্নেহের বন্ধনে জড়িয়ে থাকতেন। পরস্পর পরস্পরের ছিদ্র খুঁজে বেড়াতেন না। ভালাে লেখার জন্য যেমন দরাজ হাতে প্রশংসা করতেন, তেমনি লেখা মনঃপুত না হলে সমালােচনা করতেও ছাড়তেন না—তা আবার জানিয়ে দিতেন পত্রের মাধ্যমে। কবিশেখর সম্বন্ধে আজও আমাদের অনেক তথ্য অজানা থেকে গেছে। এই পত্রগুলি পড়লে পাঠকেরা অনেক নতুন তথ্য জানতে পারবেন।