কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন প্রধান দীনেশচন্দ্র সেন। ১৯১২-১৩ সালে তার হাতে পড়ল এক পত্রিকার এক প্রবন্ধ। প্রবন্ধকার মালীর যােগান’ নামের সেই প্রবন্ধে অনেকগুলি গীতিকার সন্ধান দিয়েছেন। আলােচনার জন্য কোথাও কোথাও ওইসব গীতিকার অংশবিশেষের উদ্ধৃতিও দিয়েছেন।
দীনেশচন্দ্র বিষয়টা নিয়ে শিক্ষিতজনের সঙ্গে আলােচনা করলেন। বেশিরভাগ লােক এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। কেউ কেউ বললেন যে, তারা খুব ছেলেবেলায় গ্রামের ছােটোলােকদের মধ্যে অমন গান-টানের চল দেখেছেন। দেখেছেন লাঙলে ভর দিয়ে শত শত কৃষক তা উপভােগও করে। তবে তা নিম্নরুচির! তারা ওসব নিয়ে দীনেশচন্দ্রকে চিন্তিত হতে নিষেধ করলেন।
দীনেশচন্দ্র কিন্তু এই চিন্তা ছাড়লেন না। বরং তিনি ওই পত্রিকার সম্পাদক কেদারনাথ মজুমদারকে লেখক চন্দ্রকুমার দে সম্পর্কে জানাতে বললেন এবং তাঁকে কলকাতায় পাঠাতে বললেন। কেদারনাথ চন্দ্রকুমার সম্পর্কে যে-সংবাদ জানালেন, তা এই যে, ময়মনসিংহের কেন্দুয়া ডাকঘরের এলাকার আইথন নামে এক গ্রামে ১৮৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তার জন্ম হয়। বাবার নাম রামকুমার। তার বাবা-মা অল্পবয়সে মারা যান। ফলে তার লেখাপড়া হয় গ্রামের পাঠশালা পর্যন্ত। ভাবুক প্রকৃতির এই ছেলেটার যে ক-বিঘে জমি ছিল, লােভী জমিদার তাও ছিনিয়ে নিয়ে তাকে নিঃস্ব করে দিল। বালক কাজ নিল এক মুদিখানায়। মাসিক বেতন এক টাকা। কিন্তু যেছেলে অবকাশ পেলে বই পড়ে, নিজে লিখতে চেষ্টা করে তাকে দোকানদারের পছন্দ হবে কেন! অতএব চাকরি গেল চন্দ্রকুমারের।
কিছুদিন স্রোতের শ্যাওলার | মতাে ঘুরে সে পেল গ্রামের তহশিলদারি। গ্রামে গ্রামে ঘােরা হল তার চাকরির অঙ্গ। এই সূত্রেই সে সন্ধান পেল ওই অমূল্য ধনের। মালীর যােগান’-এ তারই খানিক স্বাদ পেয়েছেন দীনেশচন্দ্র।
কিন্তু কলকাতায় পাঠানাের উপায় নেই। চন্দ্রকুমার তখন উন্মাদ হয়ে গেছেন। দীনেশচন্দ্র হতাশ হলেও হাল ছাড়লেন না। চন্দ্রকুমার একটু সুস্থ হতেই তাকে আনা হল কলকাতায়। নিয়মিত চিকিৎসার আয়ােজন হল। চন্দ্রকুমার স্বাভাবিক হলেন। এতদিনে তার সংগ্রহ পড়ে ফেলেছেন দীনেশচন্দ্র। পড়ে ফেলেছেন স্যার আশুতােষ মুখােপাধ্যায়। ওঁরা চন্দ্রকুমারকে মাসিক বৃত্তিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রাহক পদে নিযুক্ত করলেন। চন্দ্রকুমারের প্রথম ঝোক ছিল শিষ্টসাহিত্যের পুথি সংগ্রহের দিকে। কারণ কাজটা অপেক্ষাকৃত সহজ। কিন্তু দীনেশচন্দ্র নাছােড়বান্দা। তার নিয়মিত উৎসাহে চন্দ্রকুমার নেমে পড়লেন অসাধ্য সাধনে। এসব পালা সংগ্রহ সহজ নয়। লেখা পুথি পাওয়া যায় না। পালাগুলাে বেঁচে আছে বহুজনের স্মৃতিতে। সকলে সবটাও জানেন না। কে কোনটুকু জানেন, তারও হদিস খুঁজে বের করতে হয়। চন্দ্রকুমারের কালে নাকি ব্যাপারটা ছিল আরও কঠিন।
যা হােক, চন্দ্রকুমারের নিদারুণ শ্রমে ও ত্যাগে সংগ্রহ হয় ময়মনসিংহ গীতিকার সবকটি পালা। ওগুলি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিতও হয় দীনেশচন্দ্রের সম্পাদনায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন